পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় বাংলাদেশ!

দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলক ইবনে বতুতাকে চীনে তাঁর দূত করে পাঠান। ইবনে বতুতা চীন যাওয়ার সময়ে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি যেই স্থানে প্রবেশ করেন তার নাম দেন সোদকাওয়ান। এই স্থানটিকে কেউ কেউ সাতগাঁও এর সঙ্গে অভিন্ন মনে করলেও আজকাল এই বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত যে, সোদকাওয়ান চট্টগ্রামের সঙ্গে অভিন্ন অর্থাৎ ইবনে বতুতা বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম প্রবেশ করেন। তিনি আরো বলেন যে, তাঁর বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য শয়খ জালাল নামক এক বিখ্যাত দরবেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি আরো বলেন যে, ঐ সময়ে ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ রাজত্ব করতেন, এবং তিনি দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন বলে ঐ সুলতানের সঙ্গে দেখা করেননি। অতঃপর ইবনে বতুতার বিবরণে দেখা যায় যে, তিনি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিলেটে গিয়ে হজরত শাহ জালালের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। শাহ জালাল সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তিনি একজন উচ্চ স্তরের দরবেশ ছিলেন। তিনি বিয়ে শাদী করেননি, তিনি এক সঙ্গে চল্লিশ দিন ধরে রোজা রাখতেন, দশ দিন পর পর রোজা খুলতেন। তিনি সারা রাত এবাদত উপাসনায় মগ্ন থাকতেন। পাশ্ববর্তী এলাকার লোকেরা তাঁর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। শাহ জালাল ১৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন, এবং পরের বৎসর ইবনে বতুতা চীনে গিয়ে শোনেন যে, শাহজালালের মৃত্যু হয়েছে। (আনুমানিক ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে)। ইবনে বতুতা শাহজালালের অনেক কারামত বা অতিলৌকিক কর্মকাণ্ডের বিবরণও দেন। সিলেট থেকে ফিরতি পথে ইবনে বতুতা সোনারগাঁও আসেন এবং সেখানে থেকে জাহাজ করে জাভায় চলে যান ।
ইবনে বতুতা পশ্চিমে মরক্কো থেকে পূর্বে চীন দেশ পর্যন্ত অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি বলেন যে, বাংলার মত জিনিষপত্রের এত সস্তা দাম তিনি আর কোথাও দেখেননি। তিনি নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যের দাম উল্লেখ করেন। তবে তাঁর প্রদত্ত দাম বর্তমানের টাকার হিসাবে নির্ণয় করা খুব সোজা নয়। তবুও পঞ্চাশ বৎসর আগে নির্ধারিত মূল্য নিম্নরূপ। মনে রাখতে হবে যে গত পঞ্চাশ বৎসরে মুদ্রাস্ফীতি অনেক গুণ বেড়ে গেছে :

*চাল – আনুমানিক ৮ মণ -৭.০০ টাকা
*ধান- আনুমানিক ২৮ মণ -৭.০০ টাকা
*ঘি- আনুমানিক ১৪ মণ- ৩.৫০ টাকা
*তিল তেল -আনুমানিক ১৪ মণ – ১.৫০ টাকা
*গোলাপ জল-আনুমানিক ১৪ মণ – ৭.০০ টাকা
*চিনি- আনুমানিক ১৪ মণ – ৩.৫০ টাকা
*৮টি তাজা মুরগী- ০০.৮৮ টাকা
*৮টি তাজা ভেড়া- ১.৭৫ টাকা
*১টি দুধেল গাভী- ২১.০০টাকা
*১৫টি পায়রা -০০.৮৮ টাকা
*১৫ গজ সূক্ষ্ম সুতী কাপড়- ১৪.০০ টাকা

ইবনে বক্তৃতার সামনে একজন সুন্দরী দাসী ৭ টাকায় বিক্রি হয় এবং তিনি নিজেও অনুরূপ দামে একটি সুন্দরী দাসী খরিদ করেন তার নাম ছিল আশুরা। ইবনে বতুতার এক সঙ্গী ১৪০ টাকায় এক সুন্দর অল্প বয়স্ক চাকর খরিদ করেন। মুহাম্মদ আল- মাশহাদী নামক মরক্কোর এক ভদ্রলোক কিছুদিন সপরিবারে বাংলাদেশে বাস করেন। তিনি ইবনে বতুতাকে বলেন যে, তারা তিনজনের এক পরিবারের জন্য খাদ্য সামগ্রী যোগাড় করতে সারা বৎসরে ৭ টাকা ব্যয় হত। ইবনে বতুতা বলেন যে, সারা পৃথিবীতে এইরূপ সস্তা জিনিষপত্র আর কোথাও পাওয়া যেত না, কিন্তু এই দেশের লোকেরা তাঁকে জানান যে, তখন জিনিষপত্রের দাম অত্যন্ত চড়া ছিল। খাদ্য দ্রব্যের প্রাচুর্যের জন্য বিদেশীরা বাংলাদেশকে খুব পছন্দ করলেও তারা এই দেশের আবহাওয়া মোটেই সহ্য করতে পারত না। তাই তারা বাংলাদেশকে ‘দোজখ পুর-আজ-নিমত বা ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এক নরক রূপে অভিহিত করত।

ইবনে বতুতা নদী পথে ভ্রমণ করেন এবং নদীর উভয় তীরের প্রাকৃতিক শোভা দেখে অভিভূত হন। তিনি সবুজের ছড়াছড়ি দেখে ভূয়াসী প্রশংসা করেন। তিনি আরো বলেন যে, এ সময়ে বাংলাদেশে ফকির দরবেশের বেশ প্রতিপত্তি ছিল। জনগণ তাদের এর ভক্তি শ্রদ্ধা করত যে, নৌকায় যাতায়াত করতে তাদের কোন পয়সা খরচ হত না। তাদের আহার এবং বাসস্থানের জন্য চিন্তা করতে হত না, অভাবীদের আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হত। ফকির দরবেশেরা কোন শহরে প্রবেশ করলে তাদের অর্ধ দিনার (আটএ আনার মত) দেওয়া হত। সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহও ফকির দরবেশদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তিনি শয়দা নামক একজন দরবেশকে সোদাকাওয়ানের গভর্নর নিযুক্ত করেন, কিন্তু শয়দা বিশ্বাসঘাতকতা করে সুলতানের পুত্রকে হত্যা করেন এবং বিদ্রোহ করেন। সুলতান শয়দাকে এইকারণে শান্তি দিতে বাধ্য হন এবং তাকে হত্যা করা হয়। শয়দার সাহায্যকারীদেরও হত্যা করা হয়। ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক সমুদ্রগামী জাহাজ দেখতে পান। তাতে বুঝা যায় যে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল
গ্রন্থ :বাংলার ইতিহাস, ড. আবদুল করিম।